E= mc2 কেন ও কিভাবে?

 


E = mc2 কী এবং কেন

[ E = mcআইনস্টাইনের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সর্বাধিক পরিচিত সমীকরণ। সমীকরণটিতে ভর ও শক্তির মধ্যেকার একটি পারস্পরিক সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে। আজ ১৪ই মার্চ অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের জন্মদিন উপলক্ষে সম্প্রতি প্রকাশিত আমার “আপেক্ষিকতার তত্ত্বকথা” বইটি থেকে “ভর-শক্তি সম্পর্ক” অংশটি ভিন্ন নামে বিজ্ঞানযাত্রার পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে দেয়া হলো ]

বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের একটি উল্লেখযোগ্য ফলাফল হচ্ছে ভর ও শক্তিকে অভিন্নরূপে দেখা। ভরের সাথে যেমন শক্তি জড়িত, তেমনি শক্তির সাথে ভর জড়িত। অর্থাৎ আপেক্ষিকতার তত্ত্বে  ভর ও শক্তিকে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ বলে প্রমাণ করা যায়। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব যেহেতু আপেক্ষিক বেগে চলমান বস্তুর মধ্যেকার বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা সাপেক্ষে সকল ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেহেতু ভর-শক্তি সম্পর্কটিও  আমরা আপেক্ষিক বেগের আলোচনার মধ্য দিয়েই তুলে আনার চেষ্টা করবো। একটি ট্রেন যখন হুইসেল বাজাতে বাজাতে তোমার দিকে অগ্রসর হতে থাকে তখন সেই শব্দের তীব্রতা তোমার নিকট অনেক বেশি মনে হয়। আবার যখন তোমাকে অতিক্রম করে চলে যায় তখন শব্দের তীব্রতাও অনেক কমে আসে। আমরা জানি, শব্দ চলে তরঙ্গের আকারে। ট্রেন যখন হুইসেল বাজাতে বাজাতে তোমার দিকে অগ্রসর হতে থাকে তখন সেই শব্দের তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলো ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে তোমার কানে প্রবেশ করে। আবার যখন তোমাকে অতিক্রম করে দূরে চলে যায় তখন ঠিক বিপরীত ঘটনা ঘটে। ঘটনাটির গাণিতিক ব্যাখ্যা দেন বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান ডপলার। তাই তাঁর নামানুসারে ঘটনাটিকে ডপলার ক্রিয়া বলা হয়। ডপলার ক্রিয়া কেবল শব্দের ক্ষেত্রেই নয়, আলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ইতিমধ্যে আমরা জেনেছি, আলো এক প্রকার তরঙ্গ। দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য একেক রঙের জন্য একেক রকম। লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি বেগুনী আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম।

ক্রিশ্চিয়ান ডপলার ও ডপলার ক্রিয়া

একটি আলো যখন আপেক্ষিক গতিতে দূরে সরে যাবে তখন সেই উৎসের আলো তোমার কাছে লাল এবং যখন কাছে আসতে থাকবে তখন নীলাভ মনে হবে। নীল আলোর কম্পাঙ্ক বেশি, তাই নীল আলোর শক্তি, লাল আলোর তুলনায় বেশি। একটি স্পেস শীপে চড়ে যদি একজন নভোচারী খুব বেশি বেগে সূর্য অভিমুখে যেতে থাকে তবে আপেক্ষিকতার নীতি অনুসারে নভোচারীর কাছে মনে হবে যেন সূর্যই তার দিকে সেই বেগে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হবে যেন সূর্য থেকে নির্গত আলোকরশ্মি তড়িৎচৌম্বক বর্ণালীতে নীলের দিকে সরে গেছে। আবার যখন তিনি সূর্যকে অতিক্রম করে যাবেন তখন মনে হবে যেন সূর্য থেকে নির্গত আলোকরশ্মি তড়িৎচৌম্বক বর্ণালীতে লালের দিকে সরে গেছে। এর অর্থ, সূর্যকে অনেক

বেশি শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে। কিন্তু সূর্যের শক্তিতো সীমিত। তাহলে এই অতিরিক্ত শক্তি আসে কোথা থেকে। এর একটা কারণ হতে পারে সূর্যের আপেক্ষিক গতি (নভোচারী সাপেক্ষে)। এখানেও সমস্যা আছে। সূর্য তখনই তার শক্তি ছেঁড়ে দিবে যখন গতি মন্থর হতে থাকবে। নভোচারী তো চলছে সমবেগে, অর্থাৎ গতি মন্থর করার কোনো প্রশ্নই আসে না। সূর্যের গতি যেহেতু নভোচারী সাপেক্ষে সেহেতু সূর্য নিজেও তার গতি কমাতে পারছে না। তাহলে উপায়? হ্যা, একটা উপায় অবশ্য আছে বটে এবং সেটা হচ্ছে- সূর্যের ভর কমিয়ে। সূর্য যেহেতু আপেক্ষিক বেগ কমাতে পারছে না তাই তার অতিরিক্ত শক্তি আসছে সূর্যের ভর থেকে। আমরা জেনেছি, গতিশীল বস্তুর বেগ যতো বাড়ে ভরও ততো বাড়ে। এক্ষেত্রে সূর্য শক্তি ক্ষয় করছে আবার গতিও কমছে না। তাই বলা হচ্ছে, সেই শক্তি আসছে স্বয়ং সূর্যের ভর থেকেই। সেটা কি করে সম্ভব? কারণ পৃথিবী কাঠামো থেকে দেখলে সূর্যকে স্থির বলেই মনে হয়। অথচ আমরা পুরো কাহিনীটা তৈরি করেছি নভোচারী সাপেক্ষে সূর্যকে গতিশীল বিবেচনা করে। আসলে আপেক্ষিকতার নীতি থেকে বলা যায়, যে ঘটনা নভোচারীর জন্য বৈধ, সেটা পৃথিবীতে স্থির সকলের জন্যই বৈধ। সূর্য আলো বা তাপ উৎপন্ন করে নিউক্লিও ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে এবং এতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় হাইড্রোজেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকেও সূর্য ও অন্যান্য তারার শক্তির উৎস সম্পর্কে জানা যায়নি। তখন মনে করা হতো, সূর্যের শক্তির উৎস হচ্ছে মহাকর্ষ। আইনস্টাইনের ভর-শক্তি সম্পর্কের পথ ধরে জানা সম্ভব হলো যে, আলো ও তাপশক্তি উৎপন্ন হয় ফিউশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এবং এতে সূর্য তার ভর হারায়। সূর্য প্রতিনিয়ত তার ভর হারাচ্ছে শক্তিতে রুপান্তরনের মাধ্যমে এবং গণনা করে দেখা গেছে, সূর্য প্রতি সেকেন্ডে চার মিলিয়ন টন ভর হারাচ্ছে। তাপকে আমরা বরাবর শক্তি বলেই জেনে এসেছি। তবে এখন একথা মানতেই হবে যে, তাপের সাথেও ভর জড়িত।  একটি বৈদ্যুতিক ইস্ত্রিকে গরম করলে কিছুটা হলেও এর ভর বেড়ে যায়। একটি জগে গরম পানি ঢাললে সেই জগের ভরও বৃদ্ধি পায় যদিও সেটা পরিমাপযোগ্য হবে না। আইনস্টাইন চিন্তা করলেন, শক্তির সাথে ভর জড়িত থাকলে ভরের সাথে শক্তি জড়িয়ে থাকবে না কেন। আর এই চিন্তা থেকেই তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত সিদ্ধান্তটি দিলেন- ভর আছে এমন সকল সাধারণ বস্তুই আসলে একেকটা জমাটবদ্ধ শক্তি। সেই হিসেবে তুমি নিজেই কিন্তু শক্তির আধার এবং সেই শক্তির পরিমাণ কতো সেটা জানলে অবাক হয়ে যাবে। তোমার ভরকে আলোর বেগের বর্গ দ্বারা গুণ করো। তাহলেই পেয়ে যাবে। ১৯৩২ সালে ককরফট ও আর্নেষ্ট ওয়ালটন নামক দু’জন বিজ্ঞানী তাঁদের তৈরি করা বৈদ্যুতিক ত্বরক যন্ত্রে একটি প্রোটন দ্বারা একটি লিথিয়াম পরমাণুকে আঘাত করান। এর ফলে উক্ত পরমাণু দুটির নিউক্লিয়াস একে অপরের সাথে মিলে গিয়ে হিলিয়ামের দুটি নিউক্লিয়াস গঠন করে। হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস দুটির ভর পরিমাপ করে দেখা গেলো এদের সম্মিলিত ভর, প্রোটন ও লিথিয়াম পরমাণুর ভরের তুলনায় সামান্য কম। তোমরা তো জানো যে, ভর বা শক্তির ধ্বংস বা বিনাশ নেই। তাহলে সেই সামান্য ভরটুকু গেলো কোথায়? বলা হয়, এই হারানো ভর হিলিয়াম নিউক্লিয়াস দুটিকে গতিশক্তি প্রদানে ব্যয় হয়েছে। আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম সূর্যের শক্তি আকারে ভর হারানোর উদাহরণ দিয়ে। এবার সহজ গাণিতিক হিসাব নিকাশের সাহায্যে পুরো বিষয়টি গণনা করে দেখানো যাক। আগেই বলেছি, সূর্যের তাপকেন্দ্রিন বিক্রিয়ার মূল কাঁচামাল হচ্ছে হাইড্রোজেন। এই প্রক্রিয়ায় দুটি নিউট্রন ও দুটি প্রোটন মিলিত হয়ে হিলিয়াম উৎপন্ন হয়। নিউট্রন, প্রোটন ও হিলিয়ামের ভর বিজ্ঞানীরা হিসাব করে বের করেছেন।

২টি প্রোটনের ভর = ২ × ১.০০৮১৫ এ এম ইউ

= ২.০১৬৩০ এ এম ইউ।

[পারমাণবিক কণিকাগুলোর ভর এতোই নগণ্য যে এদেরকে কেজি বা গ্রামে প্রকাশ করা কঠিন। এতে অনেক বড় বড় সংখ্যার আবির্ভাব ঘটে। এ কারণে কণিকার ভর প্রকাশ করা হয় এ এম ইউ ইউনিটে। এ এম ইউ কে বিস্তৃত করলে হয় অ্যাটমিক মাস ইউনিট। ১ এ এম ইউ = ১.৬৬ × ১০-২৪ গ্রাম]

২টি নিউট্রনের ভর = ২ × ১.০০৮৯০৮ এ এম ইউ

= ২.০১৭৯৬ এ এম ইউ।

অতএব, ২টি প্রোটনের ভর + ২টি নিউট্রনের ভর = ৪.০৩৪২৬ এ এম ইউ

হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের ভর =  ৪.০০৩৮৭ এ এম ইউ

দেখা যাচ্ছে, হাইড্রোজেন যখন হিলিয়ামে পরিণত হয় তখন (৪.০৩৪২৬ – ৪.০০৩৮৭) = ০.০৩০৩৯ এ এম ইউ ভর কম থাকে। আবার ০.০৩০৩৯ এ এম ইউ = ২৮.৩ মেগাভোল্ট (১ এ এম ইউ = ৯৩১.১ মেগাভোল্ট)। অর্থাৎ ০.০৩০৩৯ এ এম ইউ পরিমাণ ভর থেকে ২৮.৩ মেগাভোল্ট এর বিপুল পরিমাণ শক্তি আলো ও তাপরূপে বেরিয়ে যায়। সূর্যের ভেতরে যেটা ঘটে সেটাকে বলা হয় নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া। এই বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী পরমাণুর নিউক্লিয়াসগুলো পরস্পরের সাথে জুড়ে গিয়ে নতুন পরমাণু উৎপন্ন করে। এ ধরণের আরো একটি প্রক্রিয়া আছে যেটাকে বলা হয় নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়া। এক্ষেত্রে একটি কণা দ্বারা অপর একটি পরমাণুর (আইসোটোপ) নিউক্লিয়াসকে বিদীর্ণ করা হয়। এখানেও কিছুটা ভর, শক্তি হিসেবে বের হয়ে যায়। কিন্তু সেই কিছুটা ভরকে যদি আলোর বেগের বর্গ দ্বারা গুণ করা হয় তবে সেই শক্তির পরিমাণ হয় ব্যাপক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যে ধ্বংসলীলা সাধিত হয়েছে তার কারণও এই শক্তি। হিরোশিমাতে যে বোমাটি নিক্ষেপ করা হয়েছিলো সেটাতে ব্যবহার করা হয়েছে ইউরেনিয়াম ২৩৫ আইসোটপ এবং নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত বোমায় ছিলো প্লুটোনিয়াম ২৩৯ আইসোটপ। ইউরেনিয়াম ২৩৫ আইসোটপকে আঘাত করা হয় একটি নিউট্রন দ্বারা। এতে দুটি নতুন পরমাণু ও তিনটি নিউট্রন উৎপন্ন হয়। নতুন পরমাণুর মোট ভর ইউরেনিয়ামের থেকে কম থাকে। এ সময় দুটি নিউট্রন অকেজো হয়ে যায় বা ইউরেনিয়াম ২৩৮ আইসোটপ দ্বারা গৃহীত হয়। বাকি যে নিউট্রনটি থাকে সেটা আবার ইউরেনিয়াম ২৩৫ আইসোটপকে আঘাত করে আরো শক্তি উৎপন্ন করতে থাকে। এভাবে রিয়্যাকশন চলতেই থাকে। সেজন্য এই ধরনের বিক্রিয়াকে চেইন রিয়্যাকশনও বলা হয়। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমায় প্রায় ১,২৯,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালের ৬ আগষ্ট হিরোশিমায় (১) ও ৯ আগষ্ট নাগাসাকিতে (২) দুটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়



Thanks for reading 


Sudipto Sarkar 

0 Gravity 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ