মস্তিষ্কে অনুভূতির পরিবহন

 

মস্তিষ্কে অনুভূতির পরিবহন (nerve impulse transmission)

আমাদের হাতের উপর যদি একটি মশা/পোকা কামড় দেয় তবে, আমরা কীভাবে তা টের পাই বলতে পারেন? অথবা যদি কাটার খোঁচা লাগে সে অনুভূতিটাই বা আমরা কীভাবে পাই?

আমাদের পুরা শরীরে একটা সিস্টেম কাজ করে, যার নাম স্নায়ুতন্ত্র বা নার্ভাস সিস্টেম। সব স্নায়ুগুলোর জন্যই আমরা যে কোনো স্পর্শ, গন্ধ বা ব্যথার অনুভূতি টের পাই। স্নায়ুতন্ত্র/Nervous system হলো একটা Organ সিস্টেম, যেটা নিউরন(Neuron) নামক কোষের একটা জটিল আর স্পেশাল নেটওয়ার্ক গঠন করে পুরো দেহের মধ্যে এবং দেহের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সিগনাল আদান প্রদান করে এবং বিভিন্ন অনুভূতি দেয়। স্নায়ুতন্ত্রে উপাদান গুলোর মধ্যে নিউরন, গ্লিয়াল কোষ এবং অ্যাক্সন, এ তিনে মিলে পুরো শরীরে স্নায়ু সংকেত পাঠানোর কাজটি করে। আমাদের শরীর এর স্নায়ুতন্ত্রের দুটি প্রধান ভাগ আছে-

১। মস্তিষ্ক, সুষুম্না কাণ্ড এবং চোখের রেটিনা মিলে কেন্দ্রীয় স্নায়ু তন্ত্র বা সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম(CNS)। মস্তিষ্ক খুলি দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং সুষুম্না কাণ্ড মেরুদন্ডের কশেরুকা দ্বারা ঘেরা থাকে।

২। পেরিফেরাল নার্ভাস সিস্টেম বা PNS. CNS এর সঙ্গে শরীরের যোগাযোগ রক্ষা করতে PNS সাহায্য করে।

নিউরনঃ স্নায়ুতন্ত্রের গঠনমূলক ও কার্যকরী একককে নিউরন বা স্নায়ুকোষ বলে। মস্তিষ্ক কোটি কোটি স্নায়ুকোষ (নিউরন) দিয়ে তৈরি। এই একটি মাত্র মানব মগজে রয়েছে ১,০০০ কোটি স্নায়ুকোষ বা নার্ভ সেল। আর এগুলো একটি আরেকটির সাথে সংযুক্ত রয়েছে, তেমনি শত শত কোটি স্নায়ুতন্তু দিয়ে পুরো শরীর জুড়ে। এর প্রধান কাজ হলো :

১.শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে ইলেকট্রিক ইম্পালস এর মাধ্যমে তথ্য নেয়া এবং তথ্যকে অন্য নিউরনের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পাঠিয়ে দিয়ে তদনুযায়ী প্রতিবেদন সৃষ্টি করে। ২. এটি মস্তিষ্কে যাবতীয় স্মৃতি সংরক্ষণ করে। ৩. এটি দেহের বিভিন্ন অঙ্গ ও তন্ত্রের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। ৪. এটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং তার বাস্তবায়ন করে।

নিউরনকে অনেক ভাবে ভাগ করা যায়, তবে কাজের ভিত্তিতে ৩ ভাবে ভাগ করা যায়ঃ

১. Sensory neuron: হাত দিয়ে ১টা খুব গরম বল ধরলেন! হাতের Sensory neurons গুলো এই তথ্য আপনার মস্তিকে(CNS) পাঠিয়ে দিবে যে, আপনি খুবি গরম বস্তু হাতে ধরেছেন! অর্থাৎ Sensory neuron এর কাজ হলো দেহের ভিতর অথবা বাইরের Sence/অনুভূতি মস্তিস্কের(CNS) এ নিয়ে যাওয়া।

২. Motor neuron: মস্তিষ্ক আপনার হাতের বিভিন্ন মাংসপেশিকে motor Neuron এর মাধ্যমে নির্দেশ দিবে যে যে বলটা হাতে ধরে আছেন সেটা খুব গরম এবং আপনার হাতের পেশিগুলো বলটাকে ফেলে দিতে নির্দেশ দিবে। অর্থাৎ Motor neuron মস্তিষ্কের কমান্ড বিভিন্ন অঙ্গ, পেশি, Gland কে সরবরাহ করে।

৩. Inter neurons: আমাদের মস্তিষ্কে যে ১,০০০ কোটি স্নায়ুকোষ আছে তাদের একে অপরের সাথে যুক্ত করে আর বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদানে সাহায্য করে। Inter neurons শুধু মস্তিষ্কেই থাকে।

আমাদের আলোচনার বিষয় ঠিক কীভবে অনুভুতি/ব্যাথা গুলো আমাদের মস্তিষ্কে যায়! কীভাবেইবা পেইন কিলার কাজ করে! Anesthesia কীভাবে কাজ করে! এর জন্য আমাদের নিউরনের গঠন দেখতে হবেঃ

১. কোষ দেহ(Cell body)ঃ এটি নিউরনের মুখ্য অংশ এবং এটি গোলাকার, ডিম্বাকার, মোচাকার, সুচালো প্রভৃতি বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে।

২. এক্সন(Axon): কোষদেহ থেকে উৎপন্ন বেশ লম্বা ও শাখাবিহীন তন্তুটির নাম অ্যাক্সন। অ্যাক্সনের শেষ প্রান্ত বিভক্ত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাখা সৃষ্টি করে। পরপর দুটো নিউরনের প্রথমটার অ্যাক্সন এবং পরেরটার ডেনড্রাইটের মধ্যে Synapse করে একটি স্নায়ুসন্ধি গঠিত হয়

৩. ডেন্ড্রাইট(Dendrite): কোষদেহের চারদিকে সৃষ্ট ক্ষুদ্র তন্তুময় শাখাবিশিষ্ট অংশকে ডেনড্রাইট বলে। একটি নিউরনে বহু ডেনড্রাইট থাকে।ডেনড্রাইটগুলোই আসলে মূলত সেই অংশ যা মানব দেহের বিভন্ন ইন্দ্রিয় থেকে অথবা অন্য নিউরণ থেকে তথ্য গ্রহণ করে। ডেনড্রাইটের সংখ্যা যত বেশি হবে, একটি নিউরণের তথ্য গ্রহণের ক্ষমতাও তত বেশি হবে। একটি নিউরণের ডেন্ড্রাইটের সংখ্যা ৪,০০,০০০ পর্যন্তও হতে পারে!

অর্থাৎ ১টা নিউরনের এক্সনগুলো অপর আরো অনেক নিউরনের ডেন্ড্রাইটগুলোর সাথে যুক্ত, এই নিউরনের এক্সন আবার আরো অন্য অনেক নিউরনের ডেন্ড্রাইটের সাথে যুক্ত হয়, এবাবে অনেক নিউরন একে অপরের সাথে যুক্ত হয় একটা বিশাল জালের মত নেটওয়ার্ক তৈরি করে পুরো দেহোজুরে, আর সব কেন্দ্রীভূত হয় মেরুদন্ডের স্পাইনাল কর্ডের মাধ্যমে মস্তিষ্কে। তাহলে আমরা দেখলাম এক নিউরন আরেক নিউরনের সাথে Synapse(সিন্যাপস) গঠন করে অথবা সহজ ভাষায় যুক্ত হয়।

নিউরন কীভাবে অনুভূতি/Impulse কে নিয়ে যায়?

Impulse/অনুভূতি হলো ইলেট্রিক্যাল চার্জ যেটা এক নিউরন থেকে আরেক নিউরনে প্রবাহিত হয় সোডিয়াম-পটাশিয়াম পাম্পের মাধ্যমে। কিন্তু কীভাবে?

নিউরনের এক্সনের এক্সপ্লাজম(ভিতরে) অপেক্ষা এক্সনের বাইরে ১০গুন Na+ & Cl- আয়ন থাকে এবং এক্সপ্লাজমে(ভিতরে) ২৫ গুন K+ আয়ন থাকে বাইরের থেকে। অবস্থায় একটা বৈদ্যুতিক বিভব বজায় থাকে, একে Resting Potential বলে। এমতাবস্থায় নিউরন নিষ্ক্রিয় থাকে অর্থাৎ কোনো অনুভূতি প্রবাহিত হয় না। এই অবস্থায় কিছু K+ আয়ন বাইরে যেতে পারে কিন্তু আয়ন ভিতরে আসতে পারে না, যার ফলে নিউরনের ভিতরে থাকে নেগেটিভ চার্জ আর বাইরে থাকে পজিটিভ চার্জ। আয়নের আসা যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে Na+/K+ আয়ন পাম্প।

তাহলে টোটালি নিউরনের বাইরে থাকে অতিরিক্ত পজিটিভ(+) চার্জ আর ভিতরে থাকে নেগেটিভ(-) চার্জ। ভিতরের নেগেটিভ চার্জ সাধারনত -70mv থাকে। এই -70mV হলো রেস্টিং মেম্ব্রেন পটেনশিয়াল অর্থাৎ এই অবস্থায় নিউরন কোন Impulse এর আদান প্রদান করে না। যেহেতু নিউরনের ভিতরে নেগেটিভ ভোল্ট (-70mV) আর বাইরে আছে অতিরিক্ত পজিটিভ সোডিয়াম আয়ন(Na+) , তাই পজিটিভ সোডিয়াম আয়ন(Na+) চাইবে ভিতরে প্রবেশ করে নেগেটিভ ভোল্ট কে নিউট্রাল করতে! একইভাবে নিউরনের ভিতরের পটাশিয়ামও চাইবে বাইরের আসতে! কিন্তু সোডিয়াম-পটাশিয়াম পাম্প(Na+ ও K+ কে নিয়ন্ত্রণ করে) সেটা হতে দেয় না! যদি সোডিয়াম আয়ন ভিতরে প্রবেশ করে, তাহলে এই পাম্প Na+ বের করে দেয় এবং অনুরুপভাবে K+ বাইরে গেলে ভিতরে টেনে আনে ৩ঃ২ অনুপাতে অর্থাৎ ৩টা সোডিয়াম আয়নকে বাইরে পাঠায় আর ২টা পটাশিয়াম আয়নকে ভিতরে। এবং এভাবেই -70mV এই রাখে নিউরনকে। এটাকে পোলারাইজড বলে।

আমরা যখন কোনো আঘাত পাই, তখন এই সোডিয়াম-পটাশিয়াম পাম্প বন্ধ হয়ে যায়! আর নিউরনের বাইরে থেকে হুহু করে সোডিয়াম আয়ন ভিতরে প্রবেশ করে আর পটাশিয়াম আয়ন বাইরে। এবং এর ফলে নিউরনের ভিতরে তখন হবে পজিটিভ চার্জ আর বাইরে হবে নেগেটিভ চার্জ।নিউরনের ভিতরে তখন হবে পজিটিভ চার্জ(-70mV থেকে হয়ে যায় +30mV) আর বাইরে হবে নেগেটিভ চার্জ। এটাকে ডিপোলারাইজড বলে।

এভাবে চার্জ ব্লক আকারে সামনে এগুতে থাকে, যখন এক্সনের শেষ প্রান্তে যায় যখন এই সংকেত অপর আরেক নিউরনকে দিয়ে দেয়।

 

যখন এই Action Potential নিউরনের শেষ প্রান্তে পৌছায় তখন সেখানের ক্যালসিয়াম চ্যানেল খুলে যায় এবং ক্যালসিয়াম আয়ন(Ca2+) নিউরনে প্রবেশ করে। ফলে ঝিল্লিতে আবদ্ধ নিউরোট্রান্সমিটার(NT) গুলো বের হয়ে আসে এবং পরবর্তী নিউক্লিয়াসের রিসেপ্টরে গিয়ে সংযুক্ত হয়। এখন ২টা ঘটনা ঘটতে পারেঃ
১। যদি আঘাত/Action potential বেশি হয় পরবর্তী নিউক্লিয়াসে পজিটিভ আয়ন চ্যানেল(Na+ channe) খুলে আয়ন প্রবেশ করবে আগের মত করে এবং নিউরনকে উত্তেজিত করে চার্জ ব্লক আকারে এগিয়ে যাবে পরের নিউরনের দিকে। এভাবে মাথায় গিয়ে ব্যাথার অনুভুতি দিবে।
৩। যদি আঘাত/Action potential কম হয় তাহলে Na+ channel খুলবে না।  ক্লোরাইড আয়ন চ্যানেল খুলে যায়, মেমব্রেন Hyperpolarized হয়ে যাবে এবং সংকেত আর পরের নিউরনে যাবে না! অর্থাৎ আমরা ব্যাথা অনুভব করবো না!

➤তাহলে যদি আমরা ব্যাথাকে অনুভব করতে না চাই তাহলে আমাদের প্রধান কাজ হবে
১। সোডিয়াম আয়নকে নিউরনের ভিতরে প্রবেশ করতে না দেয়া
২। ক্যালসিয়াম চ্যানেল না খুলতে দেয়া
৩। পটাশিয়াম এবং ক্লোরাইড আয়ন চ্যানেল খুলে দেয়া!
ব্যাথার অনুভবের নাটের গুরু এই সোডিয়াম আর ক্যালসিয়াম কে কন্ট্রোল করতে পারলেই ব্যাথা আর আমরা পাবো না!
অবস করা ওষুধ / Anesthesia ওষুধের কাজ কিন্তু প্রধানত এই ২ নাটের গুরুকে থামিয়েই শুরু হয়!

যদি সংক্ষেপে বলা যায়,

১। স্বাভাবিক অবস্থা(বাইরে Na+ এবং ভিতরে K+, -70mV) ➤ আঘাত ➤ Na+/K+ পাম্প বন্ধ ➤ Na+ নিউরনের ভিতরে আর K+ বাইরে চলে যায় ( বিভব -70mV থেকে +30mV হয়) ➤ এক্সনের শেষ প্রান্তে Ca2+ চ্যালেন খুলে Ca2+ ভিতরে প্রবেশ করে ➤ Ca2+ ও ভেসিকল সংঘর্ষ হয়ে নিউরোটান্সমিটার রিলিজ হয়।

২। রিলিজড নিউরোট্রান্সমিটার গুলো Next নিউরনের রিপেস্টরে সংযুক্ত হয়ে ➤ Na+ নিউরনের ভিতরে প্রবেশ করে আগের মত করে পরবর্তী নিউরনে দিকে Action Potential প্রবাহিত হয়। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ