ব্রেইন যেভাবে কাজ করে

 মানবদেহের সবচেয়ে জটিল, রহস্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে ব্রেন বা মস্তিষ্ক। মানব অস্তিত্বের সবকিছু ব্রেন দ্বারা পরিচালিত হয়। ব্রেন সম্পর্কিত জ্ঞান অর্থাৎ আত্ম-জ্ঞান এবং মানুষের মাঝে ব্যবধান হচ্ছে এক মহাসমুদ্রের। এই মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে ব্রেন সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্থাৎ আত্ম-জ্ঞান লাভ করতে পারলেই মানুষ দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গকে ব্যবহার করতে পারবে পরিপূর্ণভাবে। এখনকার অনেক সীমাবদ্ধতা ও মনোদৈহিক অসুবিধাকে অতিক্রম করতে পারবে। নিজের জন্যে সৃষ্টি করতে পারবে সাফল্য ও সম্ভাবনার নতুন মাত্রা।




প্রাণের সর্বশ্রেষ্ঠ বিকাশ মানুষ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে ব্রেনের কারণেই। হার্টকে বলা যেতে পারে একটা পাম্পমেশিন। ফুসফুসকে বলা যেতে পারে অক্সিজেন সমদ্ধকরণ যন্ত্র। কিন্তু মানুষের প্রতিটি কাজের পেছনে নিয়ন্ত্রক শক্তি হচ্ছে ব্রেন। মানুষের সকল চিন্তা ও সচেতনতার কেন্দ্র হচ্ছে ব্রেন। মানুষের সকল উদ্ভাবনী দক্ষতার উৎস হচ্ছে ব্রেন। 


ব্রেনের এই দক্ষতার কারণে মানব জাতির পূর্বপুরুষের দৈহিকভাবে তারচেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে পরাভূত করে শুধু টিকেই থাকেনি, বরং প্রাণীকূলের মাঝে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে। ব্রেনই মানুষকে প্রথম পাথরের অস্ত্র তৈরি করতে শিখিয়েছে। আর সেই ব্রেনের জেনেটিক উত্তরসূরীরাই বানিয়েছে মহাশূন্য যান। মানুষ অতীতে যা করেছে, ভবিষ্যতে যা করবে তা এই ব্রেনের ফসল। ব্রেনই মানুষকে মানুষ বানিয়েছে।


মানব জাতি ব্রেন সম্পর্কে পুরোদমে গবেষণা শুরু করেছে ৬০-এর দশক থেকে। ব্রেনের কার্যক্রম বোঝার ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের এই আগ্রহের কারণ হচ্ছে, ব্রেনের ভেতরে যা ঘটছে তা থেকে ব্রেনের বাইরে যা ঘটছে তাকে আলাদা করা যায় না। তাই প্রতিবিছরই বেশি সংখ্যক বিজ্ঞানী ব্রেনের কার্যকম নিয়ে গবেষণায় জড়িয়ে পড়ছেন। যত জানছেন, তত বেশি করে তাদের সামনে ধরা পড়ছে এ জানার সীমাবদ্ধতা। মানুষ পরমাণুকে চূর্ণ করেছে, জেনেটিক কোডকে ভাঙতে সক্ষম হয়েছে। চাঁদে পা রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এখনও স্মৃতি, শিক্ষা, সচেতনতার রহস্য রহস্যই রয়ে গেছে। তাই এখনও সে নিজেকে বুঝতে পারেনি। বিশিষ্ট বিজ্ঞান ড. ফ্রান্সিস অটো স্মীথ তাই বলেছেন, ‘মানুষকে বুঝতে হলে প্রথম ব্রেনকে বুঝতে হবে। 


কম্পিউটারের সঙ্গে এর তুলনা করা হলেও একটি আধুনিক কম্পিউটার ১০০ বিলিয়ন ‘বিট’ তথ্য জমা ও মনে করতে পারে, সেখানে ব্রেনের সামর্থ্য অসীম। কম্পিউটার অবশ্য ব্রেনের চেয়ে দ্রুত বেতন তালিকা, হিসেব তালিকা, মহাশূন্য যানের গতিপথ নির্ণয় করতে পারে। কিন্তু কম্পিউটার শুধুমাত্র সে কাজগুলোই করতে পারে যা তার নির্মাতা মানুষ তাকে করার জন্যে প্রোগ্রাম করেছে। অপরদিকে ব্রেন অনেক অনেক সূক্ষ্ম কাজ অনায়াসে সম্পন্ন করে। মানুষের হার্ট ও দম মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেন, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেন, গরম কিছুতে ছ্যাকা লাগার সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নেয় ব্রেন। আর এ নিয়ন্ত্রণ পরিচালিত হচ্ছে মানুষের সচেতনতার অজ্ঞাতে। এছাড়া ব্রেন নিজেকে নিজে মেরামত করতে পারে। ব্রেন নষ্ট হলে কোন কোন ক্ষেত্রে ব্রেনের কোন কোন অংশ অপর অংশের কাজ রপ্ত করতে ও পরিচালিত করতে শিখতে পারে, যা কম্পিউটার পারে না। কম্পিউটারকে সুইচ অফ করে বন্ধ করে দেয়া যায়, কিন্তু ব্রেনকে বন্ধ করার উপায় নেই। আপনি কাজ করুন বা ঘুমিয়ে থাকুন ব্রেন সব সময়ই সক্রিয় থাকে।


বিশ্বের একটি সুপার কম্পিউটার হচ্ছে ক্রে-১ কম্পিউটার। মিলিয়ন ক্যালকুলেশন করতে পারে। মস্তিষ্ক পারে ২০ হাজার বিলিয়ন। ক্রে-১ কম্পিউটার প্রতি সেকেন্ডে ৪০০ মিলিয়ন ক্যালকুলেশন হিসেবে একশত বছর কাজ করলে মস্তিষ্কের মাত্র ১ মিনিটের কার্যক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবে। ব্রেনের নিউরোনের যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে বিশ্ব টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাকে তুলনা করলে মস্তিষ্কের সামনে এটির তুলনামূলক অবস্থান হবে একটি চীনা বাদামের সমান। দীর্ঘ গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা মাত্র বুঝতে শুরু করেছেন যে, মস্তিষ্ক হচ্ছে এক বিস্ময়কর জৈব কম্পিউটার। যার অসীম সম্ভাবনা এখনও প্রায় পুরোটাই অব্যবহৃত রয়ে গেছে।


ব্রেন সেলগুলো যে বৈদ্যুতিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় কত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় এবং একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে যে কত সংখ্যক নিউরোন সেলের পারস্পরিক যোগাযোগ প্রয়োজন হয় তা কল্পনা করতে গেলেও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। জার্মানীর বিখ্যাত ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউটের পরিচালক ড. ম্যানফ্রেড ইগান নিরীক্ষা করে দেখেছেন যে, ব্রেনের কোন কোন কেমিক্যাল রি-অ্যাকশন সংগঠিত হতে সময় লাগে মাত্র এক সেকেন্ডের ১০ লাখ ভাগের এক ভাগ সময়। তিনি বলেছেন, একটি দ্রুতগামী গাড়ির নিচে পড়া থেকে বাঁচার জন্যে এক পা পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়া ও তা কার্যকরী করার জন্যে ১ লাখ নিউরোনের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের প্রয়োজন হয় এবং পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে।


জীবন ধারণের জন্যে অত্যাবশ্যক প্রাণ-রাসায়নিক প্রক্রিয়া চালু রাখার পুরো কাজই করে ব্রেন। এ প্রক্রিয়া যেমন জটিল তেমনি একটির সঙ্গে অন্যটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং নির্ভরশীল। এর যে কোন পর্যায়ে সমন্বয়ের বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি পুরো প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করে দিতে পারে। যেমন রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া না থাকলে খাদ্য হজম এবং তা থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্রহ করে দেহের সর্বত্র প্রেরণ করতে পারতেন না। আবার আপনি যদি খাবার শনাক্ত করতে ব্যর্থ হতেন অথবা শনাক্ত করতে পারলেও যদি সঠিকভাবে হাত ব্যবহার করে তা ধরে ঠিকমত দুই ঠোঁটের মাঝখানে মুখে প্রবেশ করাতে না পারতেন তাহলে আপনার হজম প্রক্রিয়াও কোন কাজে আসত না। কিন্তু আপনি কোন রকম চিন্তা না করেই অবলীলায় সামনের খাবার তুলে মুখে দিয়ে চিবানোর সঙ্গে সঙ্গে মুখের গ্রন্থিগুলো লালা নিঃসরণ শুরু করে দেয় আর আপনি কোন সচেতন প্রচেষ্টা ছাড়া তা গলাধঃকরণ করে পাকস্থলীতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। 


এনজাইম তৈরি হয়ে শুরু হচ্ছে পাকস্থলীর খাবার হজমের প্রক্রিয়া। হজম প্রক্রিয়ায় শরীরের জন্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগৃহীত হচ্ছে আর রেচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় অংশ শরীর থেকে নির্গত হচ্ছে। ব্রেন দেহের এই পুরো প্রক্রিয়াকে এমনভাবে পরিচালিত করে যাতে করে প্রতিটি কাজ ঠিক সময়ে শুরু হয় এবং ঠিক সময়ে শেষ হয়। একে একটা সুসমন্বিত রিলে রেসের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। যদি প্রতিটি প্রক্রিয়ার মধ্যে সমন্বয়ের কোন অভাব হত, তাহলে দেখা যেত মুখে খাবার প্রবেশ করার পরও লালা নিঃসরণ হচ্ছে না অথবা খাবার হজম না হয়েই পাকস্থলী, অন্ত্র পার হয়ে রেচন প্রক্রিয়ায় বেরিয়ে যাচ্ছে।


আমরা আগেই দেখেছি ব্রেন এই কাজগুলো সুচারু রূপে করতে পারছে, দেহের অভ্যন্তরে প্রতিটি অংশের সঙ্গে সংযোগ এবং বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার ফলে। পঞ্চ ইন্দ্রিয় কখনও কখনও ৬ষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ব্রেন পায় বাইরের তথ্য আর ভেতরের তথ্য সংগৃহীত হয় রিসিপটরের মাধ্যমে। তথ্য পাওয়ার পর এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কার্যকরী করার জন্যেও ব্রেন ও শরীরের নির্দিষ্ট অঙ্গের রয়েছে সংযোগ। ব্রেন এই তথ্য সংগ্রহ ও কর্ম নির্দেশনা প্রদান করে দুই পদ্ধতিতে। প্রথমত অতিদ্রুত পদ্ধতি নার্ভাস সিস্টেমের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত ইন্ডোক্রাইন সিস্টেমের মাধ্যমে (হরমোন দ্বারা) শ্লথ গতিতে।


ব্রেন কোন হুমকি দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেহকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত হওয়ার জন্যে কেমিক্যাল ম্যাসেঞ্জার পাঠাচ্ছে। এই কেমিক্যাল ম্যাসেঞ্জার আবার ব্রেনকে আরও সতর্ক করার কারণ হতে পারে। পরিণামে ব্রেন মূল বিপদ কেটে যাওয়ার পরও সতর্ক সঙ্কেত পাঠানো অব্যাহত রাখতে পারে। এই ফিডব্যাক লুপকে কোন না কোনভাবে সংশোধন করতে না পারলে দেহে ক্ষতিকর টেনশন সৃষ্টি করে, যা দেহের জন্যে যেমন ক্ষতিকর, তেমনি ব্রেনের সার্কিটও জ্যাম করে দেয়।























Sudipto sarkar.


want#1



















একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ