সময় সম্পর্কিত মাথা ঘোরানো কয়েকটি তত্ত্ব
এই জগতে কিছু জিনিস আছে অপরিবর্তনীয়, তাই তাদের উপর আমাদের অগাধ আস্থা। যেমন- প্রত্যেক সকালে সূর্য পূর্বদিকে উঠে আর সন্ধ্যায় পশ্চিমে অস্ত যায়, নির্দিষ্ট কাল পর পর ঋতুর বদল হয়, সময় শুধুই সামনে ছুটে চলে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই নিয়মগুলো ধ্রুব সত্য। এদের কোনো পরিবর্তন নেই।
কিন্তু সত্যি কথা হলো – সূর্য কোথাও ওঠেও না, নামেও না। সে তার জায়গাতেই চুপচাপ বসে আছে (আসলে সেও ঘুরছে গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে মাঝখানে রেখে)। বরং পৃথিবীই পশ্চিম হতে পুবে ঘোরে। এদিকে ঋতুর পরিবর্তনও আস্তে আস্তে প্রকৃতি হতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আর সময়…………সময় শুধু ছুটেই চলে না, সে মাঝে মাঝে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েও চলে। এমনকি মন চাইলে ব্রেক চেপে দাঁড়িয়েও যেতে পারে। কিভাবে? আসুন তাহলে সময় সম্পর্কিত কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং ধারণার দিকে চোখ বোলানো যাক। বিস্ময়ের মাত্রার দিক থেকে যেটা সবচেয়ে কম, সেটা দিয়ে শুরু করছি।
৭। আমাদের জীবনটা হচ্ছে রেডিও-টিভির লাইভ অনুষ্ঠান (যেটা কিছুটা বিলম্বে সম্প্রচারিত হচ্ছে)
আপনি কি বিশ্বাস করবেন যদি বলা হয় যে- আমরা যেটাকে বর্তমান বলে জানি, সেই মুহূর্তটা আসলে সামান্য অতীতে অবস্থিত? আমরা সবাই ধরে নিয়েছি যে আমাদের জীবনটা হচ্ছে একটা সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান। কিন্তু সত্যি কথা হলো, জীবন হচ্ছে একটা সরাসরি অনুষ্ঠান যেটা সামান্য বিলম্বে সম্প্রচারিত হচ্ছে। এই বিলম্বের সময়টুকু আপনার ব্রেইন বিভিন্ন জটিল এডিটিং এবং সেন্সরিং এর কাজে নিয়োজিত থাকে। সেটা হয়ে গেলেই এডিট করা অংশটুকু সে আপনার দেখার জন্যে ছেড়ে দেয়।
বিলম্বটা অবশ্য বেশি নয়- মূল ঘটনা ঘটার এবং আপনার সেটাকে অনুভব করার মধ্যকার তফাত মাত্র ৮০ মিলি-সেকেন্ড। তেমন একটা বেশি নয়, তাই না? কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা তাতে একমত নন। তারা পরীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছেন, এই সামান্য বিলম্বই “আগে কর্ম, পরে ফল” তত্ত্ব কে পালটে “আগে ফল, পরে কর্ম” করে দিতে সক্ষম। যেমন, এক পরীক্ষায় ভলান্টিয়ারদের বলা হয়েছিলো একটা বাটন চাপতে, যেটা চাপলে সামান্য পরেই একটা বাতি দপ করে জ্বলে আবার নিভে যাবে। ভলান্টিয়াররা বাটনটা ১০-১৫ বার চাপার পর দেখতে পেলো বাতিটা সামান্য কিছু পরে না জ্বলে বরং বাটনটা চাপার সাথে সাথেই জ্বলে উঠছে। অর্থাৎ, তাদের ব্রেইন যখন দেখলো যে এই সামান্য পরিমাণ বিলম্ব উহ্য করা যায় তখন সে সেটুকু কেটে এডিট করে বাদ দিয়ে দিলো। এর ফলে বাস্তবে একটু বিলম্বে বাতি জ্বললেও, ভলান্টিয়াররা বাটন চাপার সাথে সাথেই বাতি জ্বলতে দেখতে পাচ্ছিলো।
কিন্তু চমকের ব্যাপার সেটা নয়। মূল চমকটা শুরু হল একটু পরেই, যখন বিজ্ঞানীরা ভলান্টিয়ারদের কিছুই না জানিয়ে সেই বিলম্বিত অংশটুকু সরিয়ে দিলেন। অর্থাৎ বাস্তবেই এখন বাটন চাপার সাথে সাথে বাতি জ্বলছে। এরপর ভলান্টিয়ারদের যখন জিজ্ঞেস করা হল- তারা কী দেখতে পাচ্ছে, তারা পুরোপুরি বিভ্রান্ত গলায় জানালো বাটন চাপার সামান্য আগে আগেই তারা বাতিটা জ্বলতে দেখতে পাচ্ছে! ভলান্টিয়ারদের ব্রেইন পুরো জিনিসটা এডিট করতে গিয়ে এই পর্যায়ে পুরো তাল হারিয়ে ফেলেছিলো এবং “আগে কর্ম, পরে ফল” দেখানোর বদলে “আগে ফল, পরে কর্ম” দেখাতে শুরু করেছিলো।
এখনো বুঝে উঠতে পারেননি? তাহলে এটা চেষ্টা করে দেখুন: আপনার নাক এবং পায়ের একটা আঙ্গুল একই সময় স্পর্শ করার চেষ্টা করুন। সাধারণ যুক্তি বলবে যে, আপনি নাকের স্পর্শ অনুভব করবেন আগে আর পায়ের আঙ্গুলের স্পর্শ অনুভব করবেন পরে। কারণ নাক ব্রেইনের কাছে আর পায়ের আঙ্গুল ব্রেইনের সবথেকে দূরে। তাই পায়ের আঙ্গুলের চেয়ে নাকের স্পর্শের সিগন্যাল আপনার ব্রেইনে আগে পৌঁছুবে। কিন্তু বাস্তবে কি দেখছেন? দুটো স্পর্শই আপনি ঠিক একই মুহূর্তে অনুভব করছেন।
মনোবিজ্ঞানী ডেভিড ঈগলম্যানের মতে, এর কারণ হলো – ব্রেইন সবসময় চেষ্টা করে শরীরের সমস্ত অনুভূতির তথ্যগুলো একসাথে সমন্বিত করে উপস্থাপন করতে। এক্ষেত্রে সে নাকের স্পর্শের সিগন্যালটা আগে পেলেও সেটাকে প্রসেস করার পর একটু স্ট্যান্ডবাই (অপেক্ষা করিয়ে) রেখে পায়ের আঙ্গুলের সিগন্যালটা গ্রহণ করে। সেটাকে প্রসেস করে। তারপর দুটোকে একসাথে ছেড়ে দেয় আমাদের অনুভবের জন্য। ফলে আমরা দুটো স্পর্শই একসাথে অনুভব করি। আর পুরো ব্যাপারটি ঘটা সম্ভব হয় কারণ কয়েক মিলি-সেকেন্ড আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটাকে ব্রেইন আমাদের কাছে ঠিক এখন ঘটছে এমনভাবে উপস্থাপন করে থাকে বলে। ব্যাপারটা অনেকটা ঝুঁকি এড়াতে রেডিও-টিভির সরাসরি অনুষ্ঠান ৮-১০ সেকেন্ড বিলম্বে সম্প্রচার করার মত।
আমাদের বাস্তবতায় এই পুরো ঘটনার ফলাফল হল- যে যত বেশি লম্বা, সে আসলে তত বেশী অতীতে থাকে। কারণ শরীরের বিভিন্ন অংশ হতে ব্রেইনে সিগন্যাল পৌঁছুতে বেশি সময় লাগে। তার মানে হল বামনেরা বর্তমানের সবচেয়ে কাছাকাছি অংশে বাস করে।
কিন্তু এটা তো হল আমরা সময়কে যেভাবে অনুভব করি সেটা। বাস্তবে তো আর সময়ের গতি সত্যি সত্যি ধীর হয়ে যাচ্ছে না কিংবা বেড়েও যাচ্ছে না – তাই না?
৬। ভূ-পৃষ্ঠ হতে যত উঁচুতে বাস করবেন বয়সও তত তাড়াতাড়ি বাড়বে
যদি আপনি সত্যি সত্যি সময়ের বিকৃতির (time warp) অভিজ্ঞতা নিতে চান, তাহলে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠা শুরু করুন। কারণ সময় সবজায়গায় সমানভাবে চলে না- উঁচু স্থানে সময় দ্রুত চলে। এক পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা দুটো আণবিক শক্তি-চালিত ঘড়িকে (atomic clock) দুটো টেবিলে একদম সমান তলে বসান। তারপর একটা টেবিলকে ৩৩ সেন্টিমিটার উপরে উঠিয়ে দেন। দেখা যায় উপরের ঘড়িটা নিচের ঘড়ির থেকে এক সেকেন্ডের ৯০ বিলিয়ন অংশ দ্রুতগতিতে চলছে।
আণবিক ঘড়ি হচ্ছে সবচেয়ে নিখুঁতভাবে সময় প্রদানকারী ঘড়ি, এবং এই দুটো ঘড়ির মাঝে একমাত্র তফাত ছিলো পৃথিবীপৃষ্ঠ হতে তাদের উচ্চতা। এর মানে হচ্ছে যারা উঁচু স্থানে বাস করে তারা নিচু স্থানের মানুষের চেয়ে বুড়ো হয় তাড়াতাড়ি। যারা স্কোর-কার্ডে স্কোর টুকে রাখছেন, তারা নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন, খাটো মানুষেরা ২ গোল – উঁচু মানুষেরা 0 গোল!
এটাকে বলে time dilation. এমনটা ঘটে কারণ আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী অভিকর্ষের কারণে সময় এবং স্থান বেঁকে যায়। আপনি যত ভূমির কাছাকাছি থাকবেন ততবেশি পৃথিবীর অভিকর্ষ আপনার সময়ের উপরে প্রভাব বিস্তার করবে এবং সময় ধীরে চলবে। পক্ষান্তরে, আপনি যদি উঁচু স্থানে যান, তবে অভিকর্ষের টান কমে যাবার দরুণ সময়ও কম বাঁকাবে, এবং দ্রুতগতিতে চলবে।
এখানে এতক্ষণ পর্যন্ত যা বললাম তাতে দেখতেই পাচ্ছেন যে সময়টুকু পরিবর্তনের কথা বলছি – তা অতি ক্ষুদ্র এবং পুরোপুরি তাৎপর্যবিহীন। বাস্তব জীবনে এর কোন প্রভাবই চোখে পড়ে না; অবশ্য যদি না আপনি জিপিএস সিস্টেম ব্যবহার করে থাকেন। মহাশূন্যে জিপিএস স্যাটেলাইটের ভেতরে যে ঘড়ি থাকে সেটা প্রতিদিন পৃথিবীর ঘড়ি হতে ৩৮ মিলি-সেকেন্ড এগিয়ে যায়। স্যাটেলাইটের সাথে সংশ্লিষ্ট একটা কম্পিউটার প্রতিদিন সেটাকে পৃথিবীর ঘড়ির সাথে এডজাস্ট করে নেয়। তা না হলে এর ফলাফল হতো ভয়াবহ। মাত্র একদিনের ব্যবধানে পুরো জিপিএস ব্যবস্থাটাই সরে যেতো মূল অবস্থান হতে ১০ কিলোমিটার দূরে। আর ঘটনা তো সবে শুরু।
“আপনি এখন নিউমার্কেট এসে পৌঁছেছেন। ধন্যবাদ আমাদের জিপিএস সেবা গ্রহণের জন্যে!”
কিন্তু কথা হচ্ছে অভিকর্ষই একমাত্র সময়ের সাড়ে চৌদ্দটা বাজায় না………
৫। আপনি যত দ্রুত চলবেন, সময় তত ধীরে চলবে
জিপিএস স্যাটেলাইটগুলোতে আরেকটা যে ব্যাপার মুখ্য সেটা হল ‘গতি’। কোনো বস্তু যত দ্রুত চলে, সময় সেই বস্তুর জন্যে তত আস্তে চলে। আইনস্টাইন দাদুর কল্যাণে আমরা সবাই এই তথ্যটা এখন জানি। দ্রুত চলতে চলতে আপনার গতি যদি আলোর গতির কাছাকাছি চলে যায়, তাহলে সময় মোটামুটি থেমে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সময়ের গতি ধীর করতে আলোর গতিতে চলতে সক্ষম এমন স্পেসশিপের দরকার নেই আপনার। এক বিকেলে সিএনজিতে চড়ে কিংবা আপনার ভাঙ্গাচোরা গাড়িটা নিয়ে হাওয়া খেতে বের হলেই চলবে।
পূর্বে উল্লেখিত আণবিক ঘড়িগুলো ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন সময়ের গতির হ্রাস-বৃদ্ধি প্রতিদিনই আমাদের জীবনে ঘটে চলেছে, যদিও তা অতি ক্ষুদ্র পরিমাণে। একটা ঘড়িকে প্রতি ঘণ্টায় মাত্র ৩৬ কিলোমিটার বেগে ধাবমান গাড়িতে রেখে তারা দেখেছেন ঘড়িটা প্রতি সেকেন্ডে ৬ x ১০-১৬ সেকেন্ড পরিমাণ স্লো হয়ে গেছে। যারা এই সংখ্যাটা বুঝতে পারছেন না তাদের জন্যে বলি- সংখ্যাটা খুব একটা বেশি না, কিন্তু তারপরও অনেক!
অর্থাৎ, বলা যায় আপনি যদি প্রতিদিন ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার বেগে গাড়িতে চড়ে বাসা হতে কর্মস্থলে যান, তবে যতক্ষণ গাড়ি এই বেগে চলে, ততক্ষণ আপনি স্থির বসে থাকার চাইতে 0.000000000000000২ শতাংশ কম হারে বুড়ো হতে থাকেন।
“অফিস যেতে যেতেই তো মনে হয় বুড়ো হয়ে যাবো!”
আরেক পরীক্ষায় একটা আণবিক ঘড়িকে জেটপ্লেনে চড়িয়ে পুরো দুনিয়া ঘুরিয়ে আনা হয়েছিলো যেখানে এর সাথের জোড়াটাকে রেখে দেয়া হয়েছিলো বাসায় (স্বীকার করেন, আপনার হাতে যদি এমন দুটো ঘড়ি থাকতো তবে আপনিও এরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করতেন)। শুরুতে যদিও ঘড়ি দুটোর সময় একই ছিলো, পরীক্ষা শেষে দেখা গেলো ভ্রমণকারী ঘড়িটা ৫০ ঘণ্টায় ৮০০ কিলোমিটার ভ্রমণ শেষে স্থির ঘড়ির চেয়ে ২৩০ ন্যানো-সেকেন্ড পিছিয়ে আছে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ভ্রমণকারী ঘড়িটা পৃথিবী হতে অনেক উপরে দিয়ে চলার কারণে সময় এগিয়ে গিয়েছিলো (আগের এন্ট্রি অনুযায়ী ভূ-পৃষ্ঠের অনেক উপরে থাকায় সময় দ্রুত চলবে)। কিন্তু একইসাথে ঘড়িটার বেগ ছিল বেশি যার ফলে সময় পিছিয়েও যাচ্ছিলো (দ্রুত চলার কারণে সময় ধীর হয়ে যায়)। শেষমেশ দেখা গেল উপরে দিয়ে চলার কারণে ঘড়িটা যে সময়টুকু বেশি পেয়েছিলো, তার পরিমাণ দ্রুত চলার কারণে হারানো সময় থেকে কম। কিন্তু এর থেকেও বড় ব্যাপার ভ্রমণকারী ঘড়িটার যদি অনুভূতি থাকতো, তবে সে দেখতো বাড়িতে বসে থাকা ঘড়িটা তার থেকে দ্রুত চলছে। আসলে আমরা নিজেরা কখনোই টের পাওয়া সম্ভব না যে সময় ধীরে চলছে নাকি দ্রুত চলছে। শুধুমাত্র বাইরে থেকে কেউ আমাদের দেখলেই সেটা বুঝতে পারবে।
এই ব্যাপারটাই আমাদের টেনে নিচ্ছে সময়ের এই গোলকধাঁধার আরও গভীরে, যেখানে…………
৪। সময় সবার জন্যে সমান গতিতে চলে না
এই পর্যন্ত যা বললাম, তার পুরোটার ফলাফল হচ্ছে বিভিন্ন মানুষ ‘একই ঘটনা’ বিভিন্ন গতিতে চলতে দেখে। আইনস্টাইনের বক্তব্য অনুযায়ী- একটা নির্দিষ্ট গতিতে ছুটে চলা মানুষ যে ঘটনাটাকে যুগপৎ ঘটতে দেখছে, সেই একই ঘটনাটা একটা স্থির মানুষের কাছে যুগপৎ নাও মনে হতে পারে। সুতরাং বাস্তবতা হচ্ছে আলাদা আলাদা টাইমলাইন-সম্পন্ন মানুষের সমষ্টি, যাদের টাইমলাইন কখনো কখনো একজন আরেকজনের সাথে যুগপৎ মিলে যাচ্ছে কিংবা কখনো মিলছে না।
মনোবিজ্ঞানী ‘ওয়ারেন মেক (Warren Meck)’ আমাদের ব্রেইনের সময়ানুভূতি যে আপেক্ষিক সেটা প্রমাণে কয়েকটি পরীক্ষা করেছিলেন। একটা পরীক্ষায় তিনি প্রথম ধাপে কয়েকটা ইঁদুরকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর ছোট্ট লিভার টানতে শিখিয়েছিলেন। ইঁদুরেরা ঠিক ঐ নির্দিষ্ট সময় পর পরই লিভারটা টানতো। এর পরের ধাপে তিনি এমন ব্যবস্থা করলেন যাতে ইঁদুরদের সময়ের তাল-জ্ঞান পুরো হারিয়ে গেলো। কারো কাছে ১০ সেকেন্ডকেই মনে হতে লাগলো ঐ ৩০ সেকেন্ডের নির্দিষ্ট বিরতির মত, আবার কারো কাছে ৯০ সেকেন্ডকে মনে হতে লাগলো ৩০ সেকেন্ডের মত। আপনাদের কারো ইঁদুর নিয়ে ব্যাপারটা পরীক্ষার দরকার নেই। গাড়িতে চলার সময় কখনো যদি পাশে অনর্থক বকবক করা সহযাত্রী পান – তাহলে দ্রুতগতিতে চলার কারণে আপনি ধীরে বুড়ো হবেন তো ঠিকই, সেই সাথে আপনার পাশের সহযাত্রীর কারণে সময় আরও ধীরে ধীরে চলা শুরু করবে।
কথা হল, বিজ্ঞানী মেকের বক্তব্য অনুযায়ী- আমাদের সবার টাইমলাইন তো অন্যদের থেকে আলাদা বটেই, সেই সাথে প্রত্যেকের ব্রেইনে একটা নয় বরং অনেকগুলো ঘড়ি ভরে দেয়া আছে। সবকটাই একেকরকম গতিতে চলছে। সুতরাং, ট্রেনে ছুটে চলা ব্যক্তি কিংবা জিপিএস অনুসরণ করা ব্যক্তি অথবা বাসের সেই অসহায় ভদ্র যাত্রী- প্রত্যেকেই আমাদের সবার ব্রেইনের ভেতর আছে। ব্রেইন শুধু সিদ্ধান্ত নেয় কখন কার ঘড়িটা মেনে চলতে হবে।
সময়ের প্রতি আমাদের এই অনুভূতি আরও অনেকভাবে পালটে যেতে পারে। যেমন- ড্রাগ, মানসিক সমস্যা, বার্ধক্য, এমনকি দূরত্বও। সুতরাং ভবিষ্যতে দেরীতে কর্মস্থলে উপস্থিত হলে যুক্তি হিসেবে বলুন আলাদা আলাদা টাইমলাইনের কথা। এতে অনেকে আপনাকে ফাজিল ভাবতে পারে, কিন্তু সেটা কাজে ফাঁকিবাজির জন্যে নয়।
৩। নিউট্রিনো কণার আলোর চেয়ে বেশি গতিই প্রমাণ করে সময় পরিভ্রমণ সম্ভব
নিউটনীয় পদার্থবিজ্ঞান এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল সূত্র একটা কথার উপর ভিত্তি করেই বর্তমান – কোনো বস্তুই আলোর গতিতে চলতে পারেনা। এর একমাত্র ব্যতিক্রম সম্ভবত পেট খারাপের রোগীদের বদনা হাতে বাথরুমে ছুটে চলার গতি। কিন্তু বদনা হাতে বাথরুমে ঢুকার আগে এটুকু জেনে যান, নিউটনীয় পদার্থবিজ্ঞান এর হয়তো সব জায়গায় ছড়ি ঘোরানোর দিন শেষ! সার্ন (CERN) এর বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে এসেছেন- হয়তো, নির্দিষ্ট কিছু শর্তে, পদার্থের ক্ষুদ্রতর কণা নিউট্রিনোরা আলোর চেয়ে বেশি গতিতে চললেও চলতে পারে।
বর্তমানে বৈজ্ঞানিক সমাজে এই ব্যাপারটা নিয়ে ব্যাপক ইট-পাটকেল ছোঁড়াছুড়ি এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের ধৈর্য ধরে সাইড-লাইনে বসে পুরো ঘটনাটা দেখা ছাড়া উপায় নেই। যদি কোনো ভাবে সার্নের বিজ্ঞানীরা জিতে যান তবে তার মানে হচ্ছে, নিউট্রিনো কণার এই আলোর গতির চেয়ে বেশি গতিতে ছুটে চলার সাইড এফেক্ট হিসেবে আমরা পাবো সময় পরিভ্রমণ!
তবে এখানে একটু কথা আছে। গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেলের মত আগেভাগেই ইতিহাসের কোন কোন সেলিব্রেটিদের সাথে গিয়ে হ্যান্ডশেইক করবেন, সেই লিস্ট বানানোর আগে আরেকটু পড়ুন। আমরা এখানে সময় পরিভ্রমণ বলতে টাইম মেশিন বুঝাচ্ছি না। প্রথমে হয়তো আমরা শর্ট মেসেজ আকারে কোনো কিছু পাঠাতে পারবো অতীতে, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। যেমনটা রেডিও আবিষ্কারের শুরুর দিকে ‘মেরি হ্যাড এ লিটল ল্যাম্ব’ ছড়াটা বার্তা হিসেবে পাঠানো হয়েছিলো।
অর্থাৎ সময় পরিভ্রমণকারী হিসেবে বিবস্ত্র ‘আর্নল্ড শোয়ার্জেনেগার’ এর বদলে টুইটার বার্তাকে কল্পনা করুন। কিন্তু তবুও কথা থাকে। নিউট্রিনো কণারা এক প্রকার অদৃশ্য এবং সরাসরি ত্রিমাত্রিক বস্তু ভেদ করে যেতে পারে। সুতরাং, অতীতে মেসেজ পাঠালে সেটা কেউ দেখতে পাবে কিনা তাও সন্দেহ!
কিন্তু একই সাথে হয়তো এটা সেই বহুল জিজ্ঞাসিত- “কেন আমরা ভবিষ্যৎ হতে এখনো কোন টাইম ট্রাভেলার এর দেখা পাইনি” প্রশ্নের একটা যুক্তিযুক্ত উত্তরও বটে।
২। কৃষ্ণগহ্বরের সীমানায় গেলে সময় থেমে যায়
কৃষ্ণগহ্বর সম্বন্ধে একটা সাধারণ ভুল ধারণা হলো – এরা ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মত সব শুষে নেয়, কিন্তু সেটা সত্য নয়। আসল ব্যাপারটা হলো ব্ল্যাক-হোলদের ঘনত্ব এত বেশি থাকে যে এদের কেন্দ্রের অভিকর্ষ বল হয় অসীম। এটাকে বলা হয় gravitational singularity. এটাই এর আশেপাশের গ্রহাণু হতে শুরু করে আলো পর্যন্ত সব কিছুকে নিজের ভেতরে টেনে নেয়। তবে কথা হলো- একটা নির্দিষ্ট সীমার ভেতরে থেকে। আমরা একটু আগেই দেখিয়েছি, অভিকর্ষ এবং সময়ের সম্পর্কটা একটু দা-কুমড়ো টাইপের। সময় চায় ছুটে চলতে, কিন্তু অভিকর্ষ চায় সময়কে বশে রাখতে। সুতরাং, কী ঘটবে যদি সময় এমন একটা অভিকর্ষ বল দ্বারা ঘেরাও হয়ে যায় যেটা থেকে আলোও নিস্তার পায় না?
সময় থেমে যাবে। প্রত্যেকটা ব্ল্যাক-হোলকে ঘিরে বাইরের দিকে চক্রাকারে একটা এলাকা আছে। এটাকে বলে ‘ঘটনা দিগন্ত (event horizon)’। এই ইভেন্ট হরাইজন হচ্ছে ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’। অর্থাৎ এই ইভেন্ট হরাইজন রেখা অতিক্রম করে গেলে ব্ল্যাক-হোলের হাত থেকে আপনাকে বাঁচানোর সাধ্য আর কারো নেই।
ব্ল্যাক-হোলের মাথা নষ্ট করা অভিকর্ষের কল্যাণে এই ইভেন্ট হরাইজনের এপার এবং ওপারে বিচিত্র সব কাণ্ড-কারখানা ঘটে। ধরা যাক আপনি আছেন ঘটনা দিগন্তের এই পাশে এবং পুরোপুরি নিরাপদ অবস্থায়। কিন্তু আপনার বন্ধুর দফারফা অবস্থা। কারণ সে বেশি লাফঝাঁপ করতে গিয়ে ইভেন্ট হরাইজনের ওপাশে গিয়ে ব্ল্যাক-হোলের খপ্পরে পড়ে গেছে।
তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, ব্ল্যাক হোল তাকে টেনে ছিঁড়ে অণু-পরমাণুতে রূপান্তরিত করেনি। সেক্ষেত্রে আপনি দেখবেন আপনার সেই বন্ধু ব্ল্যাক-হোল দিয়ে যেতে যেতে ক্রমান্বয়ে তার গতি কমে যাচ্ছে। গতি কমতে কমতে এক পর্যায়ে সে পুরোপুরি স্থির হয়ে গেলো। আর সেই স্থির অবস্থাতেই ভাসতে থাকলো- আজীবন ধরে। যতদিন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থাকে ততদিন। অর্থাৎ, আপনার মনে হবে বন্ধুটা সারাজীবন ধরেই ব্ল্যাক-হোলের মাঝ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু আপনার বন্ধুর ক্ষেত্রে এসব কিছুই মনে হবে না। সে কোনো পরিবর্তনও দেখতে পাবে না। সময় তার জন্যে স্বাভাবিকভাবেই চলবে।
যদি কোনোভাবে আপনার সেই বন্ধুটা ব্ল্যাক-হোল থেকে আবার বের হতে পারে, তাহলে সে হয়তো দেখবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কয়েক মিলিওন বছর পেরিয়ে গেছে। টাইম ট্রাভেল যে সম্ভব এর জন্যে এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য প্রমাণ। কিন্তু ঘটনা হলো ব্ল্যাক-হোল হচ্ছে টেনিস বল সাইজের, এবং এটার মাঝে যাবার চেষ্টা করলে আপনার দেহাবশেষও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অবশ্য আমরা যখন কৃষ্ণগহ্বরের আকারের কথা বলি, তখন এর চারপাশের ঘটনা দিগন্তের আকারের কথাই বলি। এখন পর্যন্ত জ্যোতির্বিদেরা ৬ বর্গমাইল থেকে শুরু করে আমাদের সৌরজগতের সমান বিশালাকারের ঘটনা দিগন্তের সন্ধান পেয়েছেন।
যদিও সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হলো, আমাদের আর কখনোই সময় পরিভ্রমণ করা সম্ভব হবে না। এর কারণ এই নয় যে টাইম ট্রাভেল অসম্ভব। এর কারণ হলো, টাইম ট্রাভেল আবিষ্কার করতে করতে…………………
১। সময় নিজেও একদিন মারা যাবে
সময় কারো জন্যে অপেক্ষা করে না। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে একটু অদ্ভুত আচরণ করে ঠিকই, কিন্তু তারপরও সে চলতে থাকে অবিরাম। এমনকি আমাদের মৃত্যুর পরেও সে চলতে থাকবে। তবে বেশিদিন নয়!
দেখুন, মহাবিশ্ব কিভাবে চলছে সেটার বিভিন্ন ফর্মুলা বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে। অর্থাৎ প্রথমে তারা ধরে নেন যে “ব্যাপারটা এমন হলেও হতে পারে”। তারপর সেটা যুক্তি-প্রমাণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করেন। সেই প্রোবাবিলিটির হিসেবে যদি তারা ধরে নেন সময় হচ্ছে অসীম তবে গাণিতিকভাবে দেখা যায়, সঠিক সময়ে আপনার চিঠি আসা থেকে শুরু করে সঠিক সময়ে সূর্যের সুপারনোভার মাধ্যমে মারা যাওয়া পর্যন্ত সবকিছুর প্রোব্যাবিলিটিই মহা-বৈশ্বিক স্কেলে সমান। অর্থাৎ আগামীকাল আপনি একটা চিঠি পাবেন এটা যেমন সত্য, তেমনি আগামীকাল আমাদের সূর্য নিশ্চিত সুপারনোভার মাধ্যমে মারা যাবে- এটাও সমান পরিমাণ সত্য। কিন্তু দুটোর প্রোব্যাবিলিটিতো সমান হতে পারে না!
বিজ্ঞানীরা তাই ধরে নিয়েছেন, এখানে নিশ্চয়ই অন্য কোনো জবাব আছে। সেই জবাবটা হলো- সময় আসলে অসীম নয়। এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড একটা নির্দিষ্ট সময় হাতে নিয়ে আজ হতে বিলিয়ন বছর পূর্বে যাত্রা শুরু করেছিলো। একটা পর্যায় পরে বিশ্ব তো ধ্বংস হবেই, সেই সাথে সময় নিজেও মারা যাবে।
তাহলে হাতে কেমন সময় আছে? মোটামুটি ৫টা তত্ত্বের মধ্যে ৪টাতেই বলা হয়েছে সময় মারা যাবে আজ থেকে ৩.৩-৩.৭ বিলিয়ন বছর বাদে। কিন্তু ৫ম থিওরিতে বলা হচ্ছে আপনি এই আর্টিকেলটা পড়ে শেষ করার আগেই সময় মারা যেতে পারে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আমাদের জগতটা হচ্ছে দাদার আমলের সেই প্রাচীন ঘড়িটার মত। যে কোনো মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর যখন এমনটা ঘটবে, তখন আমরা সেটা টেরও পাবো না (যদি সেই সময় পর্যন্ত আমরা বেঁচে থাকি আর কি)। ব্যাপারটা দেখতে মনে হবে, আপনার সেই বন্ধুটার ব্ল্যাক-হোলের মাঝ দিয়ে যাবার মত। সবকিছু ক্রমান্বয়ে ধীর হতে থাকবে, তারপর হঠাৎ থেমে যাবে। যেটা যেখানে যে অবস্থাতে ছিল সেটা ওখানে ওভাবেই স্থির হয়ে যাবে। এভাবেই থাকবে…………বাকী পুরো অসীম কাল জুড়ে।
0 মন্তব্যসমূহ